ডেস্ক নিউজ
বাংলাদেশের কাঁধে ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা। বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও নানা অজুহাত দেখিয়ে তা ভেস্তে দেয় মিয়ানমার। সর্বশেষ চলতি মাসে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার বিষয়টি নতুনভাবে সামনে আসার পরই কূটচাল শুরু করেছে মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের ফেরানোর আলোচনাটি মাঠে আসার দুই দিনের মাথায় ২৮ আগস্ট প্রথম বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর উত্তরপাড়ায় সীমান্তের ওপাশ থেকে মর্টারের গোলা এসে পড়ে। সীমান্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়াকে ঘোলাটে করার নীলনকশা শুরু করেছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের নতুন বিরোধকে কাজে লাগিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার তাদের সীমান্তের ওপারে শক্তি বাড়াচ্ছে; একই সঙ্গে জনবলও।
গত ২৫ আগস্ট সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছিলেন জাতিসংঘের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ দূত নয়েলিন হেইজার। ওই দিন প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সেপ্টেম্বর মাসে শুরুর আশ্বাস দিয়েছে মিয়ানমার। এরই মধ্যে ৩৪ হাজার ৪০০ জনের যে নাগরিক তালিকা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে, সেটি যাচাই-বাছাই করেই প্রত্যাবাসন শুরু করবে দেশটি।
সীমান্তের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনায় নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কৌশলগত অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ বিভাগের মহাপরিচালক জ ফিউ উইন। তিনি সেখানে দাবি করেন, আরাকান আর্মি ও আরসা মিলে সীমান্তে এ পরিস্থিতি তৈরি করছে। সীমান্তের এপাশে যেসব গোলা পড়েছে, এসব দুই সশস্ত্র সংগঠনের। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বিদ্যমান ‘সুসম্পর্ক’কে নষ্ট করার উদ্দেশ্যে হামলাগুলো চালিয়েছে তারা।
তবে সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর নজর রাখেন এমন একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আরাকান আর্মি ও আরসাকে নিয়ে পুরোপুরি ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে মিয়ানমার। দুটি সংগঠনই মিয়ানমারকেন্দ্রিক হলেও তাদের আদর্শ এবং লক্ষ্য পুরোপুরি ভিন্ন। সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে এ দুটি সংগঠনের ওপর দায় চাপিয়ে আসল ঘটনা আড়ালের চেষ্টা করছে মিয়ানমার।
জানা গেছে, একসময় আরসার নাম ছিল ‘হারাকাহ আল-ইয়াকিন’। এর অর্থ, ‘বিশ্বাসের আন্দোলন’। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা তরুণদের মধ্যে যারা সিরিয়া, ইরাক, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ইসলামিক জিহাদ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছে, তাদের নেতৃত্বেই আল-ইয়াকিন প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুর দিকে এর নেতৃত্বে ছিলেন ওস্তাদ হাশিদ। ২০১৬ সালের দিকে ছিলেন আত উল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি। তিনি পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া একজন রোহিঙ্গা। আল-ইয়াকিন নাম বদলে পরে সংগঠনটি পরিচিতি পায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) হিসেবে। রোহিঙ্গা মুসলিম না হলে সাধারণত আরসায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আর আরাকান আর্মির অধিকাংশ সদস্য বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তারা। আর আরসা চায় মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য ছোট অধিকার। আরাকান আর্মির তুলনায় আরসার শক্তি-সামর্থ্য অনেক কম। ধর্মীয় আদর্শের কারণে আরসা ও আরাকান আর্মির মধ্যে দূরত্ব রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ সমকালকে বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিজেদের ঘরের ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারণ সু চি চলে যাওয়ার পর সাধারণ জনগণের সঙ্গে তাদের লড়াই শুরু হয়। যখন কোনো দেশের সামরিক বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠনগুলো আধিপত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিজের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে আরও দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে। এখন কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় আলোচনাও করতে হবে।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্নেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, আরসা ও আরাকান আর্মি একত্র হয়ে গেছে- মিয়ানমারের এমন দাবির নূ্যনতম ভিত্তি নেই। আর সীমান্তের ওপার থেকে গোলা মিয়ানমার, নাকি তাদের এলাকায় অবস্থান করা সশস্ত্র সংগঠন ছুড়েছে- এটা বড় বিষয় নয়। গোলা তাদের সীমান্ত থেকে এসেছে। তাই এর দায় মিয়ানমারকেই নিতে হবে। অতীতে এটাও দেখেছি, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অসৎ কর্মকর্তারা তাঁদের ভেতরকার সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কাছে সরকারি গোলা-অস্ত্র বিক্রি করে দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, সেপ্টেম্বরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার একটি আলোচনা চলছিল। এর মধ্যে সীমান্তে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। নিজেদের ভেতরের অশান্ত পরিবেশের অজুহাত দেখিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে আবারও বাধাগ্রস্ত করছে তারা। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবে রোহিঙ্গারাও নিজ দেশে ফেরত যেতে ভয় পাবে। আসলে রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া ব্যাহত করাই মিয়ানমারের মূল লক্ষ্য।
পালংখালী সীমান্তে গোলার শব্দ :নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ির পর এবার তীব্র গোলার শব্দ পাওয়া গেল কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমান সীমান্তে। গতকাল মঙ্গলবার সেখান থেকে নতুন করে গোলাগুলির বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। সকাল ৭টার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত দফায় দফায় মর্টার শেলের মতো ভারী অস্ত্রের গোলার শব্দে কেঁপে ওঠে পালংখালী এলাকা। এতে এই সীমান্তের মানুষ ভয়ভীতির মধ্যে রয়েছে।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর চৌধুরী বলেন, ঘুমধুম সীমান্তের পর এবার নতুন করে আমার ইউনিয়নের আঞ্জুমান সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে ভারী গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমান্তের মানুষজন যেন ভয়ে না থাকে, সে জন্য তাদের বোঝানো হচ্ছে। মিয়ানমার যা ইচ্ছা করে যাচ্ছে। তারা এবার সীমান্তে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।
পালংখালীর আঞ্জুমান সীমান্তের বাসিন্দা মো. আজিজ জানান, তুমব্রুর পর এখন আমাদের সীমান্তে মর্টার শেলের মতো গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এ সীমান্তের ১০০ পরিবারের বেশি বসবাসকারী রয়েছে। গোলাগুলির ঘটনায় এসব এলাকার মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। মূলত রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার জন্য তারা (বার্মা) সীমান্তে এ ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখছে, যাতে রোহিঙ্গারাও সীমান্তের এ পরিস্থিতি দেখে সে দেশে যেতে অনীহা প্রকাশ করে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব বলেন, ‘সকালে উখিয়া সীমান্তের গোলাগুলির শব্দ পাওয়ার কথা স্থানীয়রা অবহিত করেছে। এখানে সীমান্তের ৩০০ মিটারের ভেতরে ১০০ পরিবার রয়েছে। আমরা তাদের খোঁজখবর রাখছি। পরিস্থিতি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এক মাসের বেশি সময় ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। ওয়ালিডং ও খ্য মং সেক পাহাড়ে আরাকান আর্মির স্থাপনা ধ্বংস করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে। ফলে সীমান্তে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। এতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। এ ঘটনায় সীমান্তের ৩০০ পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথা রয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, মঙ্গলবারও সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া গেছে। মাঝেমধ্যে মর্টার শেলের শব্দে এপারের স্থলভূমি কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে, মর্টার শেল এখানে পড়ছে। এমন অবস্থায় সীমান্তের বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে।
তুমব্রু সীমান্তের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান জানান, অনেক পরিবারের নারী ও শিশুরা নিজ থেকে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।
তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার পাশে শূন্যরেখা ক্যাম্পে ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গার বসতি। এ ক্যাম্পের পেছনে লাগোয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) একাধিক চৌকি। শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘মর্টার শেলে নিহত হওয়ার পর থেকে এখানকার বাসিন্দারা বোমা আতঙ্কের মধ্য রয়েছে। এতে এখানকার রোহিঙ্গারা উদ্বিগ্ন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরা এখানে নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপও চেয়েছি।’