ডেস্ক নিউজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের দেশ ও জনগণের চিন্তা করে ব্যবসা করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি সরকারের সময় হাওয়া ভবনের দৌরাত্ম্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন লাভের ব্যাপারে আপনারা (ব্যবসায়ী) চিন্তা করেন। আগে তো একটা বড় অংশ হাওয়া হয়ে যেত। এখন আর সেই হাওয়া হওয়ার ব্যবস্থাটা নেই। সেখান থেকে সবাইকে মুক্ত রেখেছি। সেটা মাথায় রেখে দেশের জন্য ও দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে ব্যবসা করুন।
বুধবার গণভবনে ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বাংলাদেশের সকল নাগরিকের কাছে যথাযথ মূল্যে সরবরাহ করার জন্য ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের প্রতি আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্ব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আমাদের ব্যবসায়ীরা সে যে দলেরই হোক আমরা কিন্তু ওখানে দল বাছতে যাইনি। যে দলেরই হোক, যাতে তারা ব্যবসাটা ব্যবসায়ী হিসেবে করতে পারে, সেই পরিবেশটা আমি সৃষ্টি করে দিয়েছি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এখন তো কোনো হাওয়া ভবনও নেই, আর পিএমওতে (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) কোনো উন্নয়ন উইংও নাই যে, হাওয়া ভবনে একভাগ দিতে হবে, উন্নয়ন ভবনে এক ভাগ দিতে হবে বা অমুক জায়গায় দিতে হবে। এই যন্ত্রণা তো আপনাদের ভুগতে হয় না এখন আর।
এটা তো আপনারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, সেই যন্ত্রণা থেকে তো সবাই মুক্ত। এখন প্রফিটের (লভ্যাংশ) ব্যাপারে চিন্তা করেন, আগে তো একটা বড় অংশ হাওয়া হয়ে যেত। এখন আর হাওয়া হওয়ার ব্যবস্থা নাই, সেখান থেকে সবাইকে মুক্ত রেখেছি। সেটা মাথায় রেখে দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে ব্যবসা করবেন, এটাই আমার প্রত্যাশা।’
মতবিনিময়কালে গণভবনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান প্রমুখ।
শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, এস আলম গ্রুপের সিনিয়র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সালাউদ্দিন আহমেদ, দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান, মেঘনা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল, এসিআই লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আরিফ দৌলা, টি কে গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তফা হালদার, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী, সিডি এডিবল ওয়েল লিমিটেডের পরিচালক বিশ্বজিত সাহা সহ দেশের শীর্ষ কয়েকজন ব্যবসায়ী।
মতবিনিময়কালে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে বলেন, এতদিন এই ১৪ বছর একটানা ধারাবাহিকভাবে আপনারা লাভজনক ব্যবসাটা করে গেছেন, আমরা কিন্তু করোনার সময়ও সেটা মোকাবিলা করলাম। প্রণোদনা দিলাম, বিশেষ প্রণোদনা দিলাম, আমার কাছে কেউ এসে দাবি করেননি। কেউ বলে নাই। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমাদের একটা টিম খুব ভালো কাজ করছিল- যে কোথায় কী করা যেতে পারে। আমার অর্থনীতির চাকাটাকে চলমান রাখতে হবে।
সরকারপ্রধান এ সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং স্যাংশনের (নিষেধাজ্ঞা) প্রেক্ষাপটে বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ, তাদের সমস্ত কর্মকা- বন্ধ। আমরা বলেছি আমরা এখানে বন্ধ হতে দেব না। আমার এখানে চালু করে রাখতে হবে। শ্রমিকদের বেতন, এই যে গার্মেন্টস, তার বেতন তো আমি দিয়ে দিলাম সব। প্রণোদনা প্যাকেজ করলাম, বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।
দলের নাম উল্লেখ না করে বিএনপিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন যখন বিরোধী দল একটু মাঠে নেমেছে তখন ব্যবসায়ী মহলে শঙ্কার সৃষ্টি অথবা কারও মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। যদি আবার হাওয়া ভবন খুলতে পারে তাহলে কি সুবিধা পাবে বা জানি না কেন হঠাৎ দেখি এক একটা সুর তোলে এটা নাই ওটা নাই, এটা হবে না ওটা হবে না। ১৪টা বছর আমরা সরকারে, আমি জানি না ব্যবসায়ীরা এটা উপলব্ধি করে কী? এত নিশ্চিন্তে ব্যবসা করার সুযোগ তো আর পান নাই।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে এখনো আমরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। যেখানে ইংল্যান্ডে ৪০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে। আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। তারপর বিশ^ব্যাপী গ্যাসের সমস্যা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে সম্ভবত প্রথমবারের মতো তাদের মজুত থেকে তেল ব্যবহার করতে হচ্ছে যেখানে যুক্তরাজ্য বিদ্যুতের দাম ৮০ শতাংশ বাড়িয়েছে এবং সমগ্র ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যসহ শীতপ্রবণ দেশগুলোকে জ্বালানি সঞ্চয়ে শীতকালীন পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে।
সরকারের জ্বলানি ক্ষেত্রে ব্যাপক ভর্তুকি প্রদানের উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের ব্যবসার জন্য এলএনজি কিনে নিয়ে এসেও সাপ্লাই দিচ্ছি। কিন্তু যে টাকা দিয়ে আমরা কিনছি, যে খরচ পড়ছে তার চেয়ে খুব কম টাকায় আমরা দিচ্ছি। যেখানে ৬০ টাকা পড়বে পার লিটার সেখানে আমরা ৯ টাকা পার লিটারেও সবাইকে এলএনজি সাপ্লাই দিয়েছি। কিন্তু সমস্যাটা বাংলাদেশে নয় এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা সেটা মাথায় রাখতে হবে। সেসব জায়গা থেকে আমরা সার, গম বা খাবার পণ্য আনি আজকে সব জায়গায় সমস্যা।
এ বিষয়ে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ব্রাজিল থেকে সরাসরি সয়াবিন ও চিনি আমদানিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং বেসরকারি খাতগুলো ও নিজেরা যে কোনো সময় এখান থেকে পণ্য আমদানি করতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস সম্পর্কে তিনি বলেন, কোভিড-১৯ সময়কালে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছিল কারণ অবৈধ হুন্ডি প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে বেশিরভাগ রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো হয়েছিল এবং রিজার্ভ থেকে ব্যয়ও সেই সময়ে কম হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমদানি শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে, তিনি যোগ করেন যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি করা হয়েছে এবং এগুলো কাজ শুরু করলে অবশ্যই রিটার্ন পাওয়া যাবে। তিনি দেশবাসীকে কৃচ্ছ্রতা সাধন ও সঞ্চয়ের পাশাপাশি সারাদেশে তেল ও চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
মেগা প্রজেক্ট এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সরকারের সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, মেগা প্রজেক্ট, তার বিদ্যুৎ নিয়ে সমালোচনা, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট কেন আনলাম সেটা নিয়ে সমালোচনা। সেখানে না কি টাকা মেরেই খেয়ে দিলাম। যারা ওরকম টাকা খেয়ে অভ্যস্ত টাকা খাওয়ার বিষয়টা বুঝে ভালো।
কিন্তু আমরা যদি তখন এটা না আনি বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারতাম না। আমরা বলেছিলাম বিদ্যুৎ মানুষের ঘরে-ঘরে দেব, সেটা আমরা দিয়েছি। কিন্তু এখন যে ক্রাইসিস (সংকট) সেটা তো বাংলাদেশের না, এটা তো বিশ্বব্যাপী হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবাই এই ক্রাইসিসে ভুগছে।
দুর্ভিক্ষ আসতে পারে তাঁর এমন বক্তব্যের সমালোচকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কিন্তু আগাম কিছু কিছু কথা বলি-অনেকে মনে করেন আমি কেন বলি? কই থেকে বলি? এটা হচ্ছে আমার একটা ধারণা অর্থাৎ দীর্ঘদিনের একটা অভিজ্ঞতা। যখন ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধটা হলো সারা বিশ্বে, এটার অর্থনৈতিক ধাক্কাটা আসলো কিন্তু।’