আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মাত্র শেষ হয়েছে ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে ৫৪২ জন সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এসব সাংসদের অর্ধেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ধর্ষণ, হত্যা, সন্ত্রাসবাদসহ গুরুতর সব অপরাধের মামলা। ভারতের নির্বাচনবিষয়ক পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মসের (এডিআর) এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
গত শনিবার এডিআর ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৪২ জন সংসদ সদস্যের ২৩৩ জনের বিরুদ্ধেই রয়েছে গুরুতর বিভিন্ন অপরাধের মামলা, শতাংশের হারে যা প্রায় ৪৩ শতাংশ। গতকাল রোববার বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের খবরে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
এডিআরের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্তদের মধ্যে কংগ্রেসের এক এমপির বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যা, ডাকাতিসহ ২০৪টি মামলা। পার্লামেন্টে এরকম অভিযুক্তদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
এডিআরের নির্বাচনবিষয়ক প্রধান অনিল বর্মা বলেন, সংসদে একটি বিরক্তিকর প্রথা চালু হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। লোকসভায় বিজয়ী ৫৩৯ জনের ওপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। এই তালিকায় বিজেপি থেকে জয়ী ৩০৩ প্রার্থীর মধ্যে ১১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত। অন্যদিকে কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত ৫২ এমপির মধ্যে ২৯ জনের নামেই রয়েছে মামলা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, গত এক দশকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্যে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, ৩০ জনের বিরুদ্ধ হত্যা ও তিন জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। ২০০৪ সালে তাদের জরিপ শুরু হওয়ার পর ফৌজদারি অপরাধের মামলা থাকা সংসদ সদস্যের সংখ্যা এটাই সর্বোচ্চ।
এডিআর জানিয়েছে, কেরালার ইডুক্কি থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস এমপি দীন কুরিয়াকোসের বিরুদ্ধে ২০৪টি ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে। অন্যদিকে বিজেপির এমপি প্রজ্ঞা ঠাকুরের বিরুদ্ধে মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয়জনকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে, যদিও নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করছেন তিনি। তার মতোই অনেক সংসদ সদস্যই তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলোকে রাজনৈতিক মামলা হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।
এডিআর জানায়, নির্বাচিত হওয়া ১৪৬ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর মামলা রয়েছে। এর মধ্যে আবার ১২ জন অতীতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। কংগ্রসের ২৭%, বিজেপির ১৯%, বহুজন সমাজ পাটির্র ১৩%, ৪০% ইএসআর কংগ্রেস পার্টি, টিডিপির ৮% এবং টিআরএসের ১৮% শতাংশ প্রার্থী এসব মামলার আসামি। এর মধ্যে আবার ২৫ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যাচেষ্টা, ৪ জনের বিরুদ্ধে অপহরণ, ১৬ জন নারীর নির্যাতন ও ১২ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতার মামলা রয়েছে।
এডিআর আরো উল্লেখ করে, এবারের নির্বাচনে অংশ নেওয়া কংগ্রেসের ৪২%, বিজেপির থেকে ৩৬% এবং বহুজন সমাজ পার্টির ২৫% প্রার্থীই ছিলেন গুরুতর মামলার অপরাধী।
এছাড়া ফৌজদারি মামলার আসামির দিক দিয়ে এগিয়ে আছে ভারতের দক্ষিণাঞ্চল। দক্ষিণের ৯১টি আসনের মধ্যে ৩৭টি আসনের প্রাথৃীই ছিলেন ফৌজদারি মামলার আসামি। এর মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশের নান্দাল আসন থেকে আটজন, তেলঙ্গানার নিজামাবাদ থেকে সাতজন, অন্ধ্রপ্রদেশের নরসাপুরম থেকে ছয়জন এবং তেলঙ্গানার খাম্মাম থেকে আটজন প্রার্থী ছিলেন বলে এডিআরের রিপোর্টে জানানো হয়।
লোকসভা নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ প্রার্থী তাদের সম্পদ দেখিয়েছে ১ কোটি রুপি বা তার বেশি। এই তালিকায় রয়েছেন কংগ্রেসের ৬৯ জন, বিজেপির ৬৫ জন, বিএসপির ১৫ জন। অবশ্য এ তালিকায় বেশি প্রার্থী আছেন অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা ও উত্তরপ্রদেশ থেকে। অন্ধ্রপ্রদেশের ১৩২ জন, তেলেঙ্গানা ৭৭ জন এবং উত্তর প্রদেশের ৩৯ জন প্রার্থী তাদের সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি রুপির বেশি উল্লেখ করেন। তবে এডিআর বলছে, সম্পদ নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন অনেক প্রার্থীই। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে কয়েকজন প্রার্থীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই তালিকায় সবার ওপরে রয়েছেন কংগ্রেসের কোন্ডা রেড্ডির মোট সম্পদ হলো ৮৯৫ কোটি রুপির বেশি! কিন্তু তিনি তার সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেন এক কোটি রুপির বেশি। ওয়াইএসআরের প্রার্থী প্রাসাদ ভিরা পাটলরির মোট সম্পদের পরিমাণ ৩৪৭ কোটি রুপি। এছাড়া একই দলের কান্নমুরু রুজুর মোট সম্পদের পরিমাণ ৩২৫ কোটি রুপি। সম্পদ নিয়ে মিথ্যাচারিতার তালিকায় রয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার শীর্ষ তিন ধনী প্রার্থী। এ অঞ্চলের জয়দেব গলা এবং বেদা মাস্থান রাও গত অর্থবছরে যথাক্রমে ৪০ কোটি রুপি এবং ৩৩ কোটি রুপি আয় করলেও তারা সম্পদ দেখিয়েছেন এক কোটির একটু বেশি। এছাড়া টিআরএসের গদ্দাম রঞ্জিত রেড্ডির আয় ১৬ কোটি রুপি।
এদিকে পার্টির গড় সম্পদের পরিমাণ হিসাবে কংগ্রেসের ২৫ জন প্রার্থীর গড় সম্পদ ৫৭.৭৭ কোটি রুপি। টিআরএসের ১৭ জন প্রার্থীর গড় সম্পদ ৪৫.৮৭ কোটি রুপি।
কংগ্রেস ও বিজেপির ৮৩ জন প্রার্থীর রয়েছে ২১.৯৩ কোটি এবং ১৪.৫৬ কোটি রুপি সমমানের সম্পদ। এছাড়া ২৩ জন প্রার্থীর কোনো সম্পদ নেই বলে ঘোষণা করেছিলেন তারা। এ তালিকায় রয়েছে তেলেঙ্গানার চেভেলা আসন থেকে প্রেম জনতা দলের (নিবন্ধনহীন) প্রেম কুমার। তিনি তার ৫০০ রুপি ব্যাংক জমা দেখিয়েছিলন।
এডিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এবার ১,২৬৬ প্রার্থীর মধ্যে ৫২৬ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল ৫ম শ্রেণি থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত। ৬১৯ জনের ছিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এর মধ্যে বিজেপির পাঁচজন ও কংগ্রেসের তিনজনের ডক্টরেট ডিগ্রি ছিল।
এডিআর জানায়, ২০১৪ সালের সংসদে ১৮৫ জন এমপির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। তবে তারা কেউ দোষী সাব্যস্ত হননি। তাদের অনেকেই আবার সংসদে জিতে এসেছেন এ বছরও।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় সংবিধানে অনুযায়ী ক্ষমতাসীন কোনো এমপি যদি কোনো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন এবং দুই বছর বা তার বেশি মেয়াদে তার শাস্তি হয়, তাহলে তিনি আর নির্বাচনে লড়তে পারবেন না। তবে প্রথমবার নির্বাচনে লড়ছেন এমন কোনো প্রার্থী একটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলেও তাকে নির্বাচনে লড়ার সুযোগ দেওয়া হবে।