নিউজ ডেস্ক:
বর্ষায় বৃষ্টিস্নাত পদ্মাপারের এলাকা। পদ্মায় টলটলে নতুন পানির ঢেউ। এরই মাঝে ছন্দে ছন্দে বসছে পাইল। কাজ করে চলেছেন সাত হাজার শ্রমিক-কর্মচারী। সেতু নির্মাণে দরকার হবে ৭২ পাইল। শুধু এই পাইলই নয় ভারি ভারি নানা যন্ত্র অবকাঠামো নির্মাণের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি নিয়ে দেশী-বিদেশী কর্মীদের ব্যস্ততা। আর নদীর ধারে মানুষের কোলাহল, চরে কৃষকের চাষবাস, রাখাল গরু নিয়ে ছুটছে এমন দৃশ্য এখানে নিত্যদিনের। রাতের বেলাও থামছে না এ কর্মযজ্ঞ। দুপারের সংযোগ সড়কসহ প্রায় ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু এলাকার সবখানেই কাজের ছোঁয়া। এর বাইরে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড, নদী শাসন আরও কয়েক কিলোমিটার এলাকায় চলছে কাজ। পদ্মা সেতুর কাজ এখন বিশেষ এক পর্যায়ে রয়েছে।
পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হওয়া যেন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। কারিগরি কোনো জটিলতা না থাকায় দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে স্প্যান বসানো, এর সঙ্গে সঙ্গে সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানোও। তাই বলাই যাচ্ছে, অচিরেই পূরণ হতে যাচ্ছে পদ্মাপাড়ের বাসিন্দাদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সহজ সড়ক যোগাযোগ এবং নগরের মতো আধুনিক সেবার সুবিধাসমূহ অপেক্ষা করছে দুই পাড়ের বাসিন্দাদের জন্য।
মাওয়া-জাজিরা উভয় প্রান্তে পদ্মাসেতু নির্মাণ এবং এ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ত্রয়োদশ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় বাঙালির স্বপ্নের সেতুর প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ। জাজিরা পয়েন্টে নদীশাসনের পাশাপাশি সংযোগ সড়ক, ওজন সেতু এবং টোল প্লাজার কাজও শেষ।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। তবে মাওয়া অংশের সংযোগ সড়ক এবং অন্যান্য অংশের কিছু কাজ নিয়ে আরও অল্প কিছু সময় প্রয়োজন হবে। তবে সেটা যে অনেক বেশি সময়ের ব্যাপার নয়, তা-ও জানিয়ে দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। তারা আরও বলছেন, চ্যালেঞ্জিং ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো শেষ হয়ে যাওয়ায় বাকি কাজ বড় ধরনের জটিলতা ছাড়াই শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পদ্মাসেতুর মহাযজ্ঞের কারণে ইতোমধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া এবং মাদারীপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা এলাকার গ্রামীণ অর্থনীতিতে। আশেপাশে লোকেরাই কাজ করছেন সেতু প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে। আবার দেশের অন্য জেলা থেকে প্রকল্প এলাকার আশেপাশে এসে বসবাস শুরু করা কর্মীরাও অবদান রাখছেন এই অর্থনীতিতে। অন্যদিকে প্রকল্পে কর্মরত বিদেশিদের কেনাকাটায় ব্যবসা হচ্ছে স্থানীয়দের।
জাজিরা প্রান্তের নাওডোবা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী বাসিন্দা জুলহাস পোদ্দার। সেতু প্রকল্পের পাইনপাড়া, করুলী চরে বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে বিক্রি করেন তিনি। চরগুলোতে থাকা প্রায় ২০টি দোকানের মধ্যে তার একটি। পদ্মাসেতুর কারণে নিজেদের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের আশা দেখা এই প্রৌঢ় জানান, নদীর পাড়ে থেকে শুধু নদীর পাড় আর জীবনের ভাঙন দেখেছি। পদ্মাসেতু হলে আমাদের ছেলে-মেয়েরা সহজে ঢাকা যেতে পারবে। আবার যারা এখন ঢাকা থাকে, তখন তারা বাড়িতে থেকেও ঢাকার কাজ করতে পারবে। এখন আমরা এখানকার বাজারে আমাদের গাছের কাঁঠাল, আম, কলা এবং অন্যান্য জিনিস বিক্রি করি। পদ্মাসেতু হলে সরাসরি ঢাকা নিয়েও বেচতে পারবো।
জাজিরা বাজারের আরেক প্রবীণ আবদুস সামাদ। তিনি জানান, পদ্মাসেতুর কারণে এই এলাকার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার হবে। এই যে, এতো মানুষ এখন এখানে কাজ করছে। সেতুটা হয়ে গেলে আমাদের কাজের সুযোগ আরও বাড়বে। বিশেষ করে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কারণে ভিটে-মাটি না ছেড়েই ঢাকা গিয়ে কাজ করতে পারবো। আমাদের ছেলে-মেয়েরা ঢাকা গিয়ে পড়াশুনা করতে পারবে। আমরা অনেক ধরনের নাগরিক সুবিধা পাবো, যা হয়তো এমন মফস্বলে পাওয়া যায় না। সরকার এই এলাকার যে উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং উন্নয়ন করছে তাতে আমাদের জীবন আরও উন্নত হবে।
তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, নদীভাঙনের কারণে এখন আমাদের জমি নদীতে বিলীন হওয়ার শঙ্কা নেই। আমাদের ঘর-বাড়ির আশেপাশে কী সুন্দর এলাকা তৈরি করা হয়েছে! কতো সুন্দর আর প্রশস্ত রাস্তা! তাই সেতুর কাজ শেষ হলেই হয়। সেতুর কাজ যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে, আমাদের স্বপ্ন পূরণের যাত্রা ততো তাড়াতাড়ি শুরু হবে।
পদ্মাসেতু প্রকল্পে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে কাজ করে স্থানীয় যুবক নাজমুল হাসান। যথাযথ চিকিৎসার অভাবে ছোটবেলায়ই হারান মাকে। তাই পদ্মাসেতু হলে গ্রামের সবাই উন্নত চিকিৎসা পাবে বলে স্বপ্ন দেখেন এই যুবক। নাজমুল বলেন, ছোটবেলায় আম্মারে হারাইছি। একেতো গরিব, তার ওপর এইহানে ভালো কোনো হাসপাতাল আছিল না। মাঝে মাঝে ঢাকা গেলে সেইহানে বড় বড় হাসপাতাল দেখছি। পদ্মাসেতু হয়ে গেলে কেউ অসুখ হলে সেইহানে নিয়ে যাওয়া যাবে। অনেকের উপকার হইবো।
নাজমুলের মতোই পদ্মাসেতু ঘিরে সহস্র স্বপ্ন দেখছেন পদ্মাপাড়ের মানুষ তথা বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা। আর তাদের এখন অপেক্ষা শুধু বাংলাদেশের গর্ব ও অহমের প্রতীক পদ্মাসেতুর কাজ শেষ হওয়ার।