ডেস্ক নিউজ
সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপ ও ব্যাংকে সুদ কমে যাওয়া অন্যতম কারণ
ব্যাংকের সুদ হার কমে যাওয়ায় বাংলাদেশে বন্ড মার্কেটের ব্যবসা এখন রমরমা। আমানতের বিপরীতে সুদ কমে যাওয়া এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ পদক্ষেপেই সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনুকূল পরিবেশের কারণে সম্প্রতি বন্ড মার্কেটের লেনদেন সর্বোচ্চ ১৫৭ শতাংশে পৌঁছেছে। যেমনটি আগে কখনোই ঘটেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে বন্ড মার্কেটের লেনদেন ২৯ হাজার ১৮৮ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান শেয়ারবাজার নিয়ে আলাপকালে একটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সুক্কুক, রূপান্তরযোগ্য বন্ডসহ দেশের পুঁজিবাজারে অনুপস্থিত এমন কিছু পণ্যকে বাজারে আনা উচিত। এতে পণ্যের বহুমুখীকরণ বাড়বে।
অন্যদিকে সরকারের ইতিবাচক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বন্ড সুক্কুক চালু এবং সেটির প্রচারের কারণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে অপ্রচলিত এই পন্যটি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান ড. শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম এই বন্ডে বিনিয়োগের জন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আহ্বান করেছেন। তিনি বলেছেন, দুবাইয়ে রোড শোতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। রোড শো পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দেশের বিদ্যমান প্রজেক্টগুলো আসছে সেগুলোর সাইজ ৫০০ কোটি, হাজার কোটি, দুই হাজার কোটি, চার হাজার কোটি এরকম বিরাট-বিরাট সাইজ। শুধু ইক্যুইটি মার্কেট দিয়ে এটার কোন সলিউশন দেয়া সম্ভব না বলেই আমার বন্ডের কাজ করছি। বন্ডের মাধ্যমে একমাত্র আমাদের এই সলিউশন দেয়া সম্ভব। দেখা গেছে, বন্ডের কনভেনশনাল বন্ড এবং সুক্কুক মার্কেটে ট্রিলিয়ন ডলারের ওপর আছে। এবং তাদের বিনিয়োগের জায়গা তারা খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা দুবাইয়ে প্রেজেন্টেশন করলাম, প্রেজেন্টেশনে অংশ নেয়া প্রত্যেকেই আমাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা মিটিং করেছে। প্রত্যেকটা বড় বড় ইনভেস্টর। এখানে ওয়ার্ল্ডের সব নাম করা যাদের সাত ট্রিলিয়ন, তিন ট্রিলিয়ন। তারা ভাল জায়গা খুঁজছে কোথায় ইনভেস্ট করতে পারে। তাদের দেশে বিনিয়োগ করে তারা তেমন কোন রিটার্ন পাচ্ছে না। এবং এই রেটিংয়ে যেসব দেশ সেসব দেশেই তারা বিনিয়োগ করে। এছাড়াও বাংলাদেশের যে ভবিষ্যত আমরা দেখতে পাচ্ছি সামনের দিনগুলোতে আমাদের বিরাট ভূমিকা রাখতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, গত জুলাই থেকে ব্যাংকগুলোতে আমানতের বিপরীতের সুদ হার কমে যাওয়ায় বিভিন্ন সরকারী সিকিউরিটিজে এবং ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ বেড়েছে। একইসঙ্গে সেখানে সরকারী ও বেসরকারী খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে। সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতের তারল্য আগের বছরে তুলনায় ৯৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। অতিরিক্ত তারল্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঞ্চমার্ক ট্রেজারি বন্ড বাছাই করার সুযোগ রেখেছে। কারণ বেঞ্চমার্ক বন্ডে সিকিউরিটিজের ক্রেতার সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়ার সুবিধা থাকে। একইসঙ্গে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক বন্ড সুক্কুক চালুও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলেও ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সুক্কুক কি? দেশে প্রথমবারের মতো শরিয়াহভিত্তিক বন্ড ‘সুক্কুক’ বাজারে ছেড়েছে সরকার, এটির আকার ৮ হাজার কোটি টাকা। সুক্কুক একটি আরবী শব্দ, যার মাধ্যমে সিলমোহর দিয়ে কাউকে আইনী অধিকার দেয়া বোঝায়। শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী বন্ড ‘সুক্কুক’ নামেই পরিচিত। এই বন্ডের মাধ্যমে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সরকারের উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা হবে। এ বন্ডের আকার মোট ৮ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে প্রথমে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়া হয়েছে। পরে আবার ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়া হবে। ইসলামিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শরিয়াহভিত্তিক বন্ড ইস্যু করে এ খাতের তারল্যকে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া সরকারী ঋণের পোর্টফোলিও সম্প্রসারণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো এবং ব্যয় সাশ্রয়ে সরকার ইসলামী বন্ড ‘সুক্কুক’ ছাড়ার এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
ট্রেজারি বন্ড কি ॥ একসময় শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারী বন্ড ক্রয় করত। এজন্য ব্যাংক ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হতো সরকারকে। এটি বিবেচনায় নিয়ে বন্ডের বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে বীমা প্রতিষ্ঠান, ভবিষ্য তহবিল, মিউচুয়াল ফান্ড, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, পেনশন তহবিলসহ নানা ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিকে বন্ড কেনার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া অনিবাসী বা বিদেশী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু ট্রেজারি বন্ড কিনতে পারেন। ফলে বাজারে বিনিয়োগকারী বৃদ্ধির কারণে এর চাহিদাও বেড়ে যায়। চাহিদার কারণে সরকারের কস্ট অব ফান্ড উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। যেমন ৬ বছর আগে ২০ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদ হার ছিল ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। এখন সেটি ৯ শতাংশ। প্রসঙ্গত, বন্ড ইস্যু করে ঋণ নেয়া হয়। বন্ডের ক্রেতা হচ্ছেন ঋণদাতা। আর বন্ড ইস্যুকারী ঋণগ্রহীতা। শেয়ারের মতো বন্ডেরও প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। সরকার যে বন্ড বাজারে ছাড়ে তাকে ট্রেজারি বন্ড বলে।
কেন জনপ্রিয় হচ্ছে পণ্যটি ॥ গত বছরের নবেম্বর মাসে সরকারের ইস্যু করা ২৬৯টি বন্ডের মধ্যে ৩০টির বেঞ্চমাক বন্ড বা সুদ নিধারণের জন্য ক্রেতাদের সুযোগ দেয়। এখন সেই বন্ডগুলো মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিক ডিলারদের বন্ড কেনা-বেচার জন্য দুধরনের মূল ঘোষণা করতে বলে। প্রাথমিক ডিলার বা ক্রেতা ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মার্কেট ইনফ্রাস্টাকচার মডিউল অনুযায়ী যা অনলাইনে লেনদেনের জন্য সংযুক্ত গবর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ অর্ডার ম্যাচিং (জিসিওএম) দর নির্ধারণ করতে হয়। সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা জিসিওএমের মাধ্যমে সিকিউরিটিজ কেনাবেচার আগেই দর দেখে নিতে পারছে। আগে এই দেখার সুযোগ ছিল না। এছাড়া ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্যও বন্ড মার্কেটের অতিরিক্ত লেনদেনের জন্য অন্যতম কারণ।
আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিখ খান বলেন, বর্তমানে অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ফান্ড বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ঋণের স্বল্প চাহিদা তাদের সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করতে তুলছে। একইসঙ্গে করোনার সময় ব্যবসা বাণিজ্যের মন্দাবস্থাকালে সেকেন্ডারি মার্কেট নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছে। ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সরকারী সিকিউরিটিজকে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বিনিয়োগ করছে। এছাড়া ব্যবসায়িক মন্দাবস্থার কারণে অনেক ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। এর বিপরীতে সরকারী সিকিউরিটিজ নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ সবচেয়ে ভাল ক্রেডিট রেটিংয়ের ব্যাংকই গ্রাহককে ৩-৪ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে না। অন্যদিকে দুই থেকে ১০ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ৩ থেকে ৬ শতাংশ রয়েছে। একইসঙ্গে সরকার সেভিং সার্টিফিকেটে বিনিয়োগের জন্য সুদহার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ থেকে ১১.৭৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো : একজন ব্যক্তি সঞ্চয়পত্রে ৪৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে পারেন না। তবে যৌথভাবে এই পরিমাণ ১ কোটি টাকা। কিন্তু বরাবরই সর্বোচ্চ সুদের সঞ্চয়পত্রে ধনীদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু ট্রেজারি বন্ড সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিকদের উৎসাহ দেয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প অর্থায়নের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ফান্ডের দরকার হয়। ট্রেজারি বিল স্বল্পমেয়াদী হয়। মেয়াদ এক বছরের কম। বর্তমানে ১৪, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদী ট্রেজারি বিল বাজারে চালু আছে। পক্ষান্তরে ট্রেজারি বন্ড দীর্ঘমেয়াদী। বর্তমানে ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড বাজারে প্রচলিত আছে। এই বন্ডে ১ লাখ টাকা বা এর গুণিতক যে কোন অঙ্ক মূল্যের সমপরিমাণ সরকারী ট্রেজারি বন্ড কেনা যায়। ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বা ‘কুপন রেট’ বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামে ইলেকট্রনিক বিডিং সিস্টেমের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। সুদের হার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ‘মনিটরি পলিসি এ্যান্ড অপারেশন্স’ লিঙ্কে দেখানো আছে। ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রতি ছয় মাস অন্তর পরিশোধ করা হয়।
তবে এর আগে অর্থ আইন, ২০২০ এর আওতায় সরকারী বন্ড থেকে যে আয় হবে তার ওপর ৫ শতাংশ উৎসে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, সরকারী বন্ডের আয়ের ওপর সুদারোপ বন্ড মার্কেটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সেই কারণে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বন্ড সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর প্রত্যাহার চেয়ে চিঠি দেয়া হয়। প্রথমে এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরে এই কর প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানোর পর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোন কিছু অবহিত করা হয়নি। এর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফা চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে একই অনুরোধ জানানো হয়। তবে এখনও সেটির চূড়ান্ত সমাধান হয়নি।
কেমন চলছে শেয়ারবাজারের বন্ডগুলো ॥ দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক একচেঞ্জে তালিকাভুক্ত রয়েছে ট্রেজারি বন্ড রয়েছে ২২১টি। সেখানে অবশ্য সাধারণত গত এক বছরে কোন বন্ডের সেকেন্ডারিতে কোন লেনদেন হয়নি। ডিএসই কর্তৃপক্ষ এই বন্ডগুলোকে লেনদেনযোগ্য করতে চায়। অপরদিকে রূপান্তরযোগ্য কর্পোরেট বন্ড রয়েছে দুটি। ইসলামী ব্যাংক মুদারাবা পারপিচুয়াল বন্ড নামের বন্ডটির মঙ্গলারে মোট ১৭০টি ইউনিট লেনদেন হয়েছে।