ডেস্ক নিউজ
তরুণীর ঘরে বৃদ্ধ মা ও চার বছরের শিশুকন্যা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সংসার চালাতে কাজ করছিলেন ঢাকার একটি শপিংমলে। একদিন আলাপ হয় নূপুর ও পাপিয়া নামের দুই নারীর সঙ্গে। তারা ভারতের মুম্বাইতে থাকেন। সেখানে কাজ করে বেশ ভালো অর্থ উপার্জন করেন বলে জানান। তরুণীটিও মুম্বাই গেলে ভালো আয় করতে পারবেন। ওই দুই নারীর পরামর্শে তরুণী কাজের খোঁজে ভারতে যান। অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দুইদিন পরই জানতে পারেন তাকে বিক্রি করে দিয়েছেন পাপিয়া-নূপুর।
গত ২৬ এপ্রিল দালালের সহায়তায় অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন শবনম নামের (আসল নাম নয়) ওই তরুণী। সীমান্ত পার করা দালালের কাছ থেকে পান ভারতীয় সিম কার্ড। ফোনে যোগাযোগ হয় নূপুর এবং পাপিয়ার সঙ্গে। এই দুই নারীর নির্দেশে ২৮ এপ্রিল কলকাতার শিয়ালদা স্টেশন হয়ে চলে যান বিশাখাপত্তনম স্টেশনে। স্টেশনে তাকে রিসিভ করেন ভিনিত নামের এক ভারতীয় যুবক। পরে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নিয়ে যান বিশাখাপত্তনমের সুজাতা নগরের পতিতাপল্লীতে।
এই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় শবনমকে
শবনমের অভিযোগ, সুজাতানগর পতিতাপল্লীতে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন সীমান্ত পার করার আগেই বাংলাদেশি ওই দুই নারী তাকে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। বিশাখাপত্তনমে পৌঁছানোর প্রথম দিন থেকেই তার ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করেন ভিনিত ও তার সঙ্গীরা। প্রচণ্ড মারধরের পাশাপাশি জোর করে দেহ ব্যবসায় নামানো হয় তাকে। এমন অবস্থায় গতকাল সোমবার রাতে ভিনিতের অসতর্কতায় নিজের ফোন হাতিয়ে নেন শবনম। সাহায্য চেয়ে যোগাযোগ করেন ঢাকার পরিচিতদের কাছে।
ঢাকার সোর্সের মাধ্যমে সোমবার ভারতীয় সময় রাত আটটার দিকে শবনমের পাচার হওয়ার কথা জানতে পারেন সমকালের কলকাতা প্রতিনিধি। তরুণীর পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য সাহায্য চাওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ, বাংলাদেশ উপদূতাবাস এবং পশ্চিমবঙ্গের হ্যাম রেডিও অপারেটরদের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। বাংলাদেশ উপদূতাবাস থেকে দ্রুত যোগাযোগ করা হয় কলকাতা পুলিশের এসটিএফ-এর সঙ্গে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এবং উড়িষ্যা দুই রাজ্যের যোগাযোগ স্থাপনে সময় নষ্ট হচ্ছিল। তাই পশ্চিমবঙ্গের হ্যাম রেডিও অপারেটররা সরাসরি তাদের উড়িষ্যা ইউনিটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে উড়িষ্যা পুলিশ এবং উড়িষ্যা স্পেশাল টাস্কফোর্সের সঙ্গে। এদিকে শবনমের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতি মুহূর্তের তথ্য রাতভর উড়িষ্যা পুলিশ ও হ্যাম রেডিও অপারেটরদের জানানো হয়।
রাতেই তরুণীর অবস্থান চিহ্নিত করে উড়িষ্যা টাস্কফোর্স। সোমবার রাত ১১টার দিকে ঘিরে ফেলা হয় ওই পতিতা পল্লীর পুরো এলাকা। সে সময় তরুণী জানান, সেখানে একাধিক ভারী আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। ফলে সারারাত বাড়ি ঘিরে রাখলেও বাতিল করা হয় তাকে উদ্ধার অভিযান। এদিকে, পাচারকারীরা উদ্ধার তৎপরতার খবর জেনে যাওয়ায় প্রাণের ঝুঁকি তৈরি হয় তরুণীর। তরুণী জানান, এ সময় একটি ঘরে লুকিয়ে থাকেন তিনি। পাচারকারীরা বাড়ির সব আলো বন্ধ করে দেয়।
পাচারকারীদের সঙ্গে রাতভর দফায় দফায় হুমকি-পাল্টা হুমকি এবং আলোচনা চলে স্পেশাল টাস্কফোর্স ও স্থানীয় পুলিশের। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই আজ মঙ্গলবার ওই বাড়িতে ঢুকে তরুণীকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় আগ্নেয়াস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি ভিনিতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে অন্যান্য পাচারকারীরা পালিয়ে যান।
তরুণীকে উদ্ধারের পর তার মেডিকেল টেস্ট করা হয়েছে। বর্তমানে তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়েছে। আজই তাকে আদালতে তোলার কথা রয়েছে।
উদ্ধারের পর ওই তরুণী সমকাল, হ্যাম রেডিও, বাংলাদেশ উপদূতাবাস এবং ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি সমকালকে বলেন, ঈদের দিনে আজ দ্বিতীয় জন্ম হলো আমার। যত দ্রুত সম্ভব দেশে মা ও মেয়ের কাছে ফিরতে চাই। যে দুই নারীর প্রলোভনে তিনি ভারতে যান তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান ভুক্তভোগী তরুণী।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রলোভন দেখানো ওই দুই নারী ভারতের মুম্বাই ও হায়দ্রাবাদে দেহব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ থেকে একাধিক তরুণীকে ফুসলিয়ে আগেও ভারতে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
শবনমকে উদ্ধারের পর পশ্চিমবঙ্গ হ্যাম রেডিও অপারেটরের প্রধান অম্বরিশ নাগ বিশ্বাস বলেন, একজন নারীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিতে পারার চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।