নাটোরের গুরুদাসপুরে সামাজিক ফতোয়া দিয়ে একটি অসহায় পরিবারকে একঘরে করে রাখার অভিযোগ উঠেছে মসজিদের ইমাম,গ্রাম প্রধান ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। গেল দুই দিন ধরে অমানবিক জীবন যাপন করছে ফতোয়ার শিকার ওই পরিবারটি। ঘটনাটি ঘটেছে গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের দেবোত্তর গরিলা গ্রামে। গত শনিবার বাদ আছর রানীনগর মোল্লাপাড়া মসজিদের ইমাম মাওলানা নুরুজ্জামান মসজিদে বসে একঘরে করার ফতোয়াটি জারী করেন। এ সময় সেখানে গ্রাম্য মাতব্বর ও স্থানীয় ইউপি সদস্য (৬ নম্বর ওয়ার্ড) মোসাব্বের আলীসহ গ্রামের প্রায় ৬০-৭০ জন উপস্থিত ছিলেন। ফতোয়ার শিকার পরিবারের পঞ্চাশোর্ধ এক নারীর সাথে তাঁর মেয়ে জামাইয়ের অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ এনে এই ফতোয়া দিয়ে একঘরে রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন গ্রাম্য মাতব্বররা। একই সাথে ওই নারীর যুবতী মেয়েকে তার স্বামীর পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে তারা। বর্তমানে মেয়েটি এখন মায়ের সাথে অবস্থান করছেন।
গ্রাম্য মাতব্বরদের আনা অভিযোগ অস্বীকার করে ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, মেয়ে জামাই তার সন্তানের মত। বেশ কিছুদিন আগে তার ভাইয়ের কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার করে মেয়ে জামাইকে দিয়েছিলেন। গত সোমবার সন্ধ্যার পর ধারের টাকা পরিশোধ করে জামাইকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। রাত ৮টার দিকে রানীনগর মোল্লাপাড়ার একটি পুকুরপাড় দিয়ে ফেরার সময় একই গ্রামের শুকচাঁদ আলী ,কামরুল ইসলাম, আতহার হোসেন ও আলামিন নামে চার যুবক তাদের পথরোধ করে। এসময় তারা অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ এনে তাঁদের (জামাই-শ্বাশুরী) বেঁধে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
এরই এক পর্যায়ে তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা চাঁদাদাবী করে ওই চার যুবক। চাঁদার টাকা দিয়ে অপারগতা জানালে গ্রামের লোকজন ডেকে এনে গ্রামে নিয়ে যায় তারা। জামাই-শ্বাশুরীকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালানোর পর রাত ১২ টার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অনৈতিক সম্পর্কের অজুহাতে মেয়ে জামাইসহ তাকে বেদম মারপিটসহ শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। জামাইকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তার মেয়েকে জোর করে তার বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। এনিয়ে পুলিশকে কোন অভিযোগ না দেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। নিজেদের নিরাপত্তার কারনে থানায় অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেনা তারা।
এরপর গত শনিবার গ্রাম্য মাতব্বর ওসমান আলী, রমজান আলী, মকছেদ আলী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোসাব্বের আলী যোগসাজশ করে রানীনগর মোল্লাপাড়া মসজিদে সামাজিক বিচার বসান। রানীনগর মোল্লাপাড়া মসজিদের ইমাম মাওলানা নুরুজ্জামানকে সেখানে উপস্থিত করেন তাঁরা। সামাজিক বিচারে শ্বাশুরী-জামাইকে উপস্থিত রেখে শরীয়ত পরিপন্থী অপরাধের জন্য তওবা পড়ান ইমাম নুরুজ্জামান। শ্বাশুরী-জামাইয়ের অনৈতিক সম্পর্র্র্র্কের কারনে তাদের মেয়ে আর স্ত্রী নয় বলে ফতোয়াদেন ওই মাওলানা। এর পর থেকে স্বামীর ঘর ছেড়ে মায়ের বাড়িতে অবস্থান করছে মেয়ে।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত জামাতা জানালেন , গ্রাম্য মাতব্বরদের হুমকী ও ভয়ভীতির কারনে কারনে সামাজিক বিচারে প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি। একতরফা ভাবে রায় ও সামাজিক ফতোয়া দিয়ে তাদের ওপর অবিচার করা হয়েছে। অথচ শ্বাশুরী তার মায়ের মত। ইমাম সাহেব ফতোয়া দিয়ে তার স্ত্রীকে আলাদা করে দিয়েছে। আইনের আশ্রয় না নেওয়ার জন্য ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ফতোয়ার কারনে তাদের ২০ বছরের সংসার ভাঙ্গতে বসেছে। এ অবস্থায় তাদের সম্মান শেষ হয়ে গেছে। ফতোয়া জারী করা ব্যক্তিরা সমাজের ক্ষমতাধর। তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলার নাই। তাদের চাহিদা মত চাঁদা দিয়ে দিলে এই ধরনের নোংড়া পরিবেশ তৈরী হতনা। তিনি এর সঠিক বিচার দাবী করেন।
ভুক্তভোগী নারীর মেয়ে বলেন, তাদের সংসার জীবনে ১৫ বছর ও ২ বছর বয়সি দুইটি ছেলে রয়েছে। স্বামী সন্তান নিয়ে তাদের সুখের সংসার। কিন্তু তার মাকে ঘিরে মিথ্যা অভিযোগ এনে তার সংসার তছনছ করে দিচ্ছে গ্রামের কিছু মাতব্বর। ভাঙ্গতে বসেছে তাদের ২০ বছরের সংসার জীবন। ফতোয়ার কারনে হাটবাজারে কিংবা বাড়ির বাইরে পর্যন্ত বের হতে পারছেনা তাঁরা। এই অন্যায় ফতোয়াবাজির সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবী করেন তিনি।
এ বিষয়ে ইউপি সদস্য মোসাব্বের আলী ও আলামিন হোসেন বলেন , গ্রাম্য শালিশ বসিয়ে তাদের অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। মসজিদের মাওলানা ইসলামী শরীয়া মোতাবেক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। সেই বিচারে গ্রামের মাতব্বরদের সমর্থন রয়েছে। পরে বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে তিনিও তাদের সাথে একমত হয়েছেন।
ফতোয়া সম্পর্কে মাওলানা নুরুজ্জামান বলেন, ইসলামী দৃষ্টিতে জামাই-শ্বাশুরীর মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক থাকলে স্ত্রী সম্পর্ক থাকেনা। গ্রামবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। তবে জামাই শ্বাশুরীকে নির্যাতের বিষয়টি তাকে জানায়নি গ্রামের মাতব্বররা।
নাজিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত রানা বলেন, বিষয়টি তিনি জানার পর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোজাহারুল ইসলামকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন তিনি। পরে পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা তা তার জানা নাই।
এ ব্যাপারে গুরুদাসপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোজাহারুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এমন কোন বিষয়ে তাকে কেউ কোন অভিযোগ দেওয়নি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।