নিজস্ব প্রতিবেদক:
নাটোরের এক সময়ের বাড়ি বাড়ি ঘুৃরে শান্তি মলম, চুড়ি, মালা ও ফিতা ফেরি করে বিক্রি করা আব্দুল কাদের শেখ এখন আধ্যাত্মিক পীর বাবা বনে গেছেন। পড়াশুনা করেছেন কিনা সেটাও জানেন না তিনি। কোন দিন নামাজ পড়েন না। তার ভক্তরাই তাকে বই পড়ে শোনান। সমাজের সহজ সরল মানুষের কাছ থেকে এই ভন্ড বাবা ভন্ডামি করে হাতিয়ে নিচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। নাটোরে ফেরি করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামের বউ ঝি দের কাছে চুড়ি, মালা, ফিতা বিক্রি করার পর চলে যান দালালি পেশায়। পেশা হিসেবেই বেছে নেন ট্রাক বন্দোবস্তকারী অফিসের দালালির কাজ। বেশ কিছুদিন সেই দালালি কাজ করেন। কিন্তু সেই দালালি থেকে খুব বেশী টাকা আয় হতো না। তখন তার পরিবারের সদস্যদের অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটতো। তখন অনাহারে দিন কাটালেও এখন তার বসবাস সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত এসি কামরায়।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, মলম বিক্রেতা আব্দুল কাদের শেখ হঠাৎ করেই নাটোর শহরতলীর বনবেলঘরিয়া এলাকায় আধ্যাত্মিক পীর বাবার পরিচয় দিয়ে খুলে বসেন বনবেলঘরিয়া দরবার শরীফ। সমাজের সহজ সরল মানুষকে ভক্ত বানিয়ে হাতিয়ে নেয়া শুরু করেন লাখ লাখ টাকা। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনি এখন কোটি কোটি টাকার ধন সম্পদের মালিক। এলাকাবাসীর কাছে কাদের ভান্ডারী বলে পরিচিত এই ব্যক্তি নিজেকে আধ্যাতিক অর্থাৎ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবি করেন। মানুষকে নানা ধরণের সমস্যার সমাধান করে দেয়ার নামে করে যাচ্ছেন প্রতারনা। এছাড়া প্রতি বছর দুইবার ওরসের নামে ভক্তদের নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা উপহার নেন। এক সময় মাটির কুঁড়ে ঘরে বসবাস করা কাদের ভান্ডারী এখন সরকারী খাস জায়গা দখল করে দ্বোতলা বিশাল আলিশান বাড়ি নির্মান করে তুলেছেন। পাশাপাশি দরবার শরীফের নামে ভক্তদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের নামে কিনেছেন বিঘাকে বিঘা জমি। পুরো বাড়ি সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। একমাত্র ছেলে আনোয়ার হোসেন বাবুকে শহরের সদর হাসপাতাল রোডে করে দিয়েছেন বড় পাইকারী দোকান। এই আধ্যাত্মিক পীর বাবা নামে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। সে নিজেকে হযরত আজিজুল ইসলাম শাহ’র বিক্রমপুরীর খলিফা দাবি করেন। আজিজুল ইসলাম শাহ’র বিক্রমপুরী বেঁচে নেই। তার মাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে নাটোরের এই মলম বিক্রেতা নিজেকে অলৌকিক খেলাফত প্রাপ্ত বলে দাবি করে গড়ে তুলেছেন মাজার। নানান পেশার মানুষের পাশাপাশি নারীরাও নিয়মিত যাতায়াত করেন এই ভন্ড বাবার দরবারে।
বনবেলঘড়িয়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, সত্তরের দশকে ঢাকার বিক্রমপুর থেকে খালি হাতে নাটোরে আসেন কাদের শেখ। পেটের ভাত জোগাতে এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুৃরে শান্তি মলম, চুড়ি, মালা ও ফিতা বিক্রি করতেন। পরে হঠাৎ করে নিজেকে আধ্যাত্মিক বাবা বলে দাবী করা শুরু করেন। এখানে দূর দূরান্ত থেকে অনেক নারী পুরুষ মানত করতে আসে। আগতদের ধর্মের অপব্যখা দিয়ে বিপদগামী করছে এই আব্দুল কাদের। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে ভন্ড বাবা কাদের ভান্ডারী প্রতারণা বানিজ্য চালিয়ে আসছে। এই কথিত দরবার শরীফের বদৌলতে তিনি অঢেল ধন সম্পদের মালিক বনে গেছেন। বিশাল দ্বোতালা বাড়ির নিচতলায় দরবার শরীফে তার বসার জন্য গদিযুক্ত আলীসান চেয়ার, খাট, বিছানা, টেবিলে থড়ে থড়ে সাজানো বই। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত শয়ন কক্ষ। প্রতিটি ঘরই আসবাবপত্রে ঠাসা। পুরো কার্যক্রম সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভক্ত জানান, ভক্ত আশেকানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি জমিগুলো কিনেন। যে সম্পদগুলো ওয়াকফ করার কথা ছিল। তিনি ওয়াকফ না করে সে জমিগুলো তাঁর একমাত্র ছেলে বাবুর নামে লিখে দিয়েছেন। এই প্রতারকের আমরা বিচার দাবী করছি। নিজেকে পীর বাবা দাবী করা আব্দুল কাদের লোকজনের বিশ্বাস অর্জন করতে প্রতি বৃহস্পতিবার তার দরবারে জিকির ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করছেন। বৃহস্পতিবার তার দরবারে গেলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, কাদের ভান্ডারী সব সময় দাবী করেন, তিনি অলৌকিক ভাবে মানুষের কলব পরিস্কার করেন। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে অনেক অসাধ্য সাধন করেন। কিন্তু তিনি কখনো নামাজ রোজা করেন না। জুম্মার নামাজ পর্যন্ত পড়েন না। ওরসের নামে করেন গান বাজনা। মসজিদের থেকে বাবার দরবার বেশি পবিত্র বলে দাবী করেন। নামাজ নয় আগে কলব পরিষ্কার করা লাগবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলা এবং নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার রামশা কাজীপুরসহ দেশের নানা স্থানের ভক্তবৃন্দের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে বিকাশের মাধ্যমে তিনি নিয়মিত হাদিয়া আদায় করেন।
আব্দুল কাদের এই প্রতিবেদকের কাছে অকপটে স্বীকার করেন , তিনি এক সময় শান্তি মলম বিক্রি করতেন। ফেরিওয়ালা হিসেবে চুরি মালা ফিতা বিক্রি করেছেন। তবে এই বিশাল দ্বোতালা বাড়ি এবং জমিজমা সবই তার স্ত্রীর ভাই আজিজুল ইসলাম তাদের কিনে দিয়েছেন বলে তিনি দাবী করেন। ভক্ত আশেকানদের কাছ থেকে বিকাশে টাকা গ্রহণ করার কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেন । তিনি লেখাপড়া জানেন না। আগত ভক্তরাই তাকে বই পড়ে শোনান। এতো সম্পদের মালিক হলেও তার কোন আয়কর ফাইল নেই। এলাকাবাসী এই ভন্ড প্রতারক কাদের ভান্ডারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রশাসনের নিকট দাবী জানিয়েছেন।
নাটোর জেলা ইমান অকিদা সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা খবির উদ্দীন জানান , দরবার শরীফের নামে ভন্ডামী প্রতারণা ইসলাম সমর্থন করেনা । আমরা কাদের ভান্ডারীর অনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে অভিযোগ পেয়েছি । এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই বিষয়ে নাটোরের পুলিশ সুপার সাইফুর রহামন জানান, কেউ অভিযোগ করলে অবশ্যই তদন্তপূর্বক আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, খাস জমি দখল সহ পীর পরিচয়ে সহজ সরল মানুষের সাথে প্রতারণার সাথে জড়িত কোন ব্যক্তিকে ছাড় দেয়া হবেনা । দ্রুত তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে ।