ডেস্ক নিউজ
পোশাক খাতের সঙ্গে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাজারও চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বিশ্ববাজারে বেড়েছে চাহিদা। তাই কম দামে এসব পণ্য আমদানিতে ক্রেতাও বাড়ছে। যে কারণে এক বছরের ব্যবধানে এ জাতীয় পণ্যের বিশ্ববাজারে চাহিদা বেড়েছে ৩২ শতাংশের বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্মপদ্ধতি এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ বিশ্বমানের নয় এমন অভিযোগ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। এ জন্য বাংলাদেশের চামড়া কেনা কমিয়ে দিয়েছিল ইউরোপীয় ক্রেতারা। এমন অবস্থায় বাজারটি হয়ে পড়ে চীন নির্ভর। তারা বলছেন, ইউরোপের বাজারটি পুরোপুরি দখলে নেওয়াই এখন তাদের লক্ষ্য।
তবে প্রথাগত বাজারের বাইরে রাশিয়া ও মরক্কোর মতো নতুন বাজারের সন্ধান পাওয়ায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
এদিকে, রপ্তানি আরও বাড়ানোর জন্য বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবসের আওতায় ‘চামড়া খাতের রপ্তানির রূপরেখা’ খসড়া প্রণয়ন করা হচ্ছে। রূপকল্পটি হালনাগাদের কাজ করছে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)।
রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ২৪৫ দশমিক ১৮ মিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩২ দশমকি ২৩ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের রপ্তানি হয়েছে ৯৪১ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন ডলার।
প্রতিবছর চামড়া খাত থেকে যে বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে, তার প্রায় ১০ শতাংশ রপ্তানি করে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, কয়েক বছর ধরে চামড়া খাতের রপ্তানিতে বেশ খারাপ অবস্থা চলছিল। করোনার ধাক্কায় তা আরও নাজুক হয়। তবে ইউরোপের দেশগুলোতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকায় রপ্তানি বাড়ছে। তিনি বলেন, জুতাসহ চামড়াজাত সব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। আগামী দিনগুলোতে এ খাতের রপ্তানি আরও বাড়বে।
এমসিসিআই সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি কারণে রপ্তানি বাড়ছে। যেমন গত আড়াই বছরে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়নি। আবার মহামারির প্রথম দিকে বেতন-ভাতার সমস্যা নিরসনে সরকার প্রণোদনা দিয়েছিল। এমনকি কোভিডের সময় রপ্তানি খাতে ১৫ দিনের বেশি কাজ বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে এত দিন পুরো বিশ্ব চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন সবাই বুঝতে পারছে, এক দেশের ওপর অতি নির্ভরশীলতা কাটাতে হবে, যা বাংলাদেশের সামনে সুযোগ তৈরি করেছে। এসব কারণেই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিতে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এই প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে তাদের আরও বেশি কমপস্নায়েন্স হতে হবে বা নিয়মনীতি মানতে হবে। বিশেষ করে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার আরও বেশি কার্যকর করতে হবে।
আবার ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি করা সম্ভব হলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে উন্নীত হবে বলে মনে করছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। দেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানি নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণেই এই পদক্ষেপ সরকারের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, ‘সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা অর্জন করা সম্ভব। কারখানাগুলোকে কমপস্নায়েন্স করতে হবে। সরকারের নীতি সহায়তাও আরও বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতা আকৃষ্টে লেদার ওয়ার্কিং গ্রম্নপের সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ। তবে কারখানাগুলো পুরোপুরি কমপস্নায়েন্স না হলে এই সার্টিফিকেট পাওয়া সম্ভব নয়। আর বিদেশি ক্রেতা ও পণ্যের দাম বেশি পেতে এটা অবশ্যই প্রয়োজন।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, কমপস্নায়েন্স ঠিক না থাকায় বিদেশিরা এখন কম দামে চামড়া কিনছেন। এটি হলে এই পণ্যের দাম হবে আর রপ্তানি আয়ও বাড়বে। তবে বাংলাদেশের মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান এই সার্টিফিকেট পেয়েছে। বড় অংশই কমপস্নায়েন্স না হওয়ায় সার্টিফিকেট পায়নি, যা এই খাতে রপ্তানি বৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায়।
ব্যবসায়ীরা জানান, এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৬ লাখ ও পরোক্ষভাবে আরও তিন লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে চামড়া শিল্পের অবদান প্রায় ৪ শতাংশ আর দেশের মোট জিডিপির ০.৫ শতাংশ।
বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে এখন শীর্ষ দেশ চীন। বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানির বড় বাজার চীনসহ, ইতালি, স্পেন, হংকং। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণে নীতি সহায়তা পেলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ ‘কমপস্নায়েন্স’ নিশ্চিত করা। কারণ বৈশ্বিক বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর মূল নিয়ামক হিসাবে কাজ করে চামড়া খাতের পণ্যগুলোর কমপস্নায়েন্স।
২০১৯ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে শিল্প মন্ত্রণালয়। তাতে ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপিতে এই খাতের অবদান বাড়িয়ে ১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানির পরিমাণ ১১২.৪১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়। এরপর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৩.৪০ কোটি ডলারে।
এরপর থেকে পরপর তিন বছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ কমছে। করোনা মহামারির সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ৭৯.৭৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ২১.৭৯ শতাংশ কম।
তবে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪.১৬ কোটি ডলার।
গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের নতুন একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্যের বিশ্ব বাজারের আকার ৬২৪.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে।
তথ্যনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী রপ্তানিকৃত চামড়াজাত পণ্যের ৩০.৩ শতাংশ রপ্তানি করে চীন। এর ফলে বিশ্বের শীর্ষ চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে দেশটি। বিশ্বব্যাপী মোট রপ্তানির ১৭.৮ ও ১৪.৮ শতাংশ ইতালি ও ফ্রান্সের। ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো এশিয়ান দেশগুলো রপ্তানি ছিল ৬.৪ ও ২.৬ শতাংশ।
ইপিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি। দ্বিতীয় স্থানে সিমেন্ট, লবণ, পাথর, আকরিক এবং পেট্রোলিয়াম বাই-প্রোডাক্টের মতো শিল্পজাত দ্রব্য। তৃতীয় স্থানে পাট ও পাটজাত পণ্য। এরপরই চামড়া শিল্প।