দেশে কোভিড-১৯ মহাদুর্যোগকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন, নির্যাতন আর অসহায় অবস্থার শিকার হচ্ছেন নারীরা। তাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এখন কঠিন চ্যালেজ্ঞের মূখোমূখি। অন্যদিকে আসন্ন সময়ে স্কুলগামী মেয়েশিশুদের ঝড়ে পড়া, বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাওয়া সহ নানাবিধ সংকট বাড়বে বলে নানা মহল থেকে ধারনা করা হচ্ছে। এসব বিবেচনায় লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে যে, আপদকালীণ এ সময়ে সবচেয়ে বেশি সংকটজনক অবস্থা হচ্ছে নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতির। এরমানে হচ্ছে সকল দূর্যোগ আর মহামারীর ধকল সকলকে সইতে হলেও নারীর জীবনে এর প্রভাব হচ্ছে ভয়াবহ। কোভিড-১৯ মহাদুর্যোগের সময়ে সকল প্রকার কাজ বন্ধ থাকার কারণে নারীদের এতোদিনের অর্জিত সঞ্চয় দিয়ে পরিবারের নিয়মিত খরচ চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নারীরা যখনই বাঁধা দিচ্ছেন তখনই তার উপর নেমে আসছে বিভিন্ন রকমের নির্যাতন। দেখা গেছে যে, নারীদের শ্রমে এবং মেধায় গড়ে ওঠা ছোট ছোট উদ্যোগ ও ব্যবসার পুঁজি এখন পরিবারের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে, এর ফলে তাদের আগামীদিনের চলার পথ আরও সংকটময় হবে বলে তারা জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে নারীদের যে অর্থনৈতিক অবদান ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তা কমে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ করোনা কালীন লকডাউনের সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি- নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তার পরিবার দ্বারা। কারণ ঘরে খাবার নাই। কাজ নাই। কিন্তু ক্ষুধা আছে। আর এর দায় গিয়ে পড়ছে নারীর উপর। অন্যদিকে নারীর ছোট ছোট ব্যবসা আর গৃহিত উদ্যোগসমূহ ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছে। তার আয়ের ক্ষেত্র ক্রমান্নয়ে সীমিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ জীবনে এসব উদ্যোগের পিছনে এতদিন সামাজিক সংগঠনসমূহ দাড়িয়েছিল নারীদের পাশে। প্রয়োজনীয় ঋণ ও প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে তারা নারীদের আয়মূখি করে তুলেছিল। কিন্তু কঠিন এ বাস্তবতায় নারীরা হারিয়ে ফেলছে তাদের ব্যবসার মূলধন। বন্ধ হয়ে গেছে তাদেও ব্যবসা। সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আর পরিবারের চাহিদার নিকট তারা হেরে যাচ্ছেন ক্রমাগত। নিজেদের আয় বাড়িয়ে সংসারে বা সমাজে যে তারা মর্যাদার আসনে নিজেদের দাড় করিয়েছিলেন তা আজ কঠিন সংকটের মূখোমূখি। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে অল্পকিছুদিন পরেই সংগঠনসমূহ যখন কাজে ফিরবেন তখন এই নারীরা কীভাবে তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবেন? কিংবা কীভাবে আবার ঘুরে দাড়াবেন? একথাটি এখনই ভেবে দেখতে হবে। এইসাথে এর সমাধান বের করতে হবে।
অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, এ করোনাকালীন সময়ে এনজিও ঋণ কার্যক্রম না থাকায় নারীরা আবার মহাজনদের নিকট থেকে চড়া সুদের প্রতিশ্রুতিতে ঋণ গ্রহণ করছেন। পরিবারের মূল্যবান দ্রবাদি বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরকমোর নানা চেষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তারা পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখছেন। অন্যদিকে শ্রমজীবী পরিবারগুলোর পুরুষ সদস্যরা কাজের প্রয়োজনে এসময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করে শ্রম দিয়ে আয় করে থাকেন। একইসাথে এসময়ে নারী সদস্যরা তাদের ছোট ছোট উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে সংসারের আয় বৃদ্ধি করেন। এ ধরনের যৌথ আয় থেকে বছরের একটা বড় সময় তারা পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। লকডাউন জনিত কারণে এবার উভয়েই তারা এধরনের কাজ এবং আয় থেকে বঞ্চিত হলেন। এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব মোকাবেলা করতে হবে পরিবারসমূহে। ফলস্বরূপ নারী পড়তে যাচ্ছে সংকটের মূখে। করোনাকালীন এই সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি কমে যাচ্ছে নারীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ। ফলে সে নিজের পরিবার,প্রতিবেশি এবং প্রতিষ্ঠানের নিকট হারিয়ে ফেলছে তার গ্রহণযোগ্যতা। এটি নারী পুরূষের মধ্যেকার দূরত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে সকলে মনে করেন। আর এর পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী সময়ে স্কুলগামী মেয়েশিশুদের ড্রপআউট এবং বাল্যবিবাহের হার বাড়বে বলে পর্যবেক্ষকেরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ইতোমধ্যে বাল্যবিবাহের হার বাড়ছে বলে সংবাদ বের হচ্ছে।
সব বিবেচনায় নারীর অগ্রগতি, অর্জন, সাফল্য আজ চ্যালেঞ্জ এর মূখোমূখি। করোনা সংকট হয়ত কেটে যাবে কিন্তু এসময়কালে উদ্ভত সামাজিক সংকটগুলোর জন্য আমাদেও চরম মূল্যে প্রদান করতে হবে। আর তাই বসে না থেকে এখন থেকেই সংকট মোকাবেলায় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। চলমান এবং আগামীদিনের সংকট সমূহকে মাথায় রেখেই তা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে সংশ্লিষ্ঠ সকলে মনে করেন। এসময়ে বেসরকারি সংগঠনগুলো কতটা আবার নারীদের পাশাপাশি দাড়াতে পারবে তা নিয়ে রয়েছে নানাবিধ প্রশ্ন। কিন্তু নারীবান্ধব এই সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। দাড়াতে হবে মানুষের বিশেষ করে নারীদের পাশে। এজন্য প্রয়োজনে সমাজ সেবা অধিদপ্তর বা মহিলা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে সহজ শর্তে ও সুদবিহীন ঋণ কার্যক্রম চালু করে উদ্যোক্তা নারীদের পাশে দাড়াতে হবে। সাহস যোগাতে হবে। নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়নের অগগতির স্বার্থেই এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে সকলে মনে করেন।
উন্নয়ন কর্মী ও মুক্ত সাংবাদিক।